স্বাস্থ্যসচেতেন মানুষদের কাছে তোকমা দানা বেশ পরিচিত। আয়ুর্বেদিক ভেষজ চিকিৎসায় তোকমা বীজ অন্যতম একটি উপাদান। তোকমা এক প্রকার গুল্ম জাতীয় সপুষ্পক উদ্ভিদ। স্থানভেদে সবজা বীজ, মিষ্টি বাসিল, ফালুদা বীজ, বিলাতি তুলসি কিংবা তুর্কমারিয়া বীজ হিসেবে পরিচিত। বহু গুণ রয়েছে ছোট কালো রঙের বীজটির। তোকমার বৈজ্ঞানিক নাম হাইপ্টিস সয়াভেলেনস।
তোকমার আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চল। দক্ষিণ এশিয়াতে তোকমার চাষ বেশি হয়। স্বাস্থ্য রক্ষায় মূলত ব্যবহার করা হয় তোকমা গাছের বীজ। তোকমার বীজ দিয়ে শরবত তৈরিসহ নানান উপায়ে খাওয়া হয় ভেষজ গুণাবলী পেতে, গুঁড়া করে ব্যবহার করা যায় রূপচর্চাতেও। বিভিন্ন ফলের জুস ও ফালুদা তৈরিতে তোকমা দানা ব্যবহার করা হয়।
বিশেষ করে ওজন কমাতে দারুণ উপকারী তোকমার বীজ। এই বীজ দ্বারা তৈরি শরবত বিপাকক্রিয়ার হার কমায়, অতিরিক্ত ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তে ভালো কোলেস্টরল তৈরি করে। আর তাই বাড়তি ওজন হটিয়ে শরীরকে সুস্থ ও আকর্ষণীয় রাখতে তোকমা অন্যতম কার্যকরী ভেষজ উপাদান।
চমৎকার পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার তোকমার দানা। তোকমা বীজে রয়েছে ৪২ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২০% প্রোটিন, ২৫% ফ্যাট (প্রায়) এবং প্রচুর পরিমান ফাইবার। পাশাপাশি ওমেগা-৩, ফ্যাটি এসিডের অন্যতম একটি ভালো উৎস এটি। এছাড়াও এতে থাকছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, ম্যাগনেসিয়াম ও সামান্য ভিটামিন সি।
তোমকা বীজ অসময়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা, ক্ষুধা দমন, অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত রাখে। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই শরবত একই সঙ্গে দূর করবে ক্লান্তি, পেটের প্রদাহ, পীড়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য। পাশাপাশি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অল্প পরিমাণ তোকমার দানা রাখলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিপাক প্রক্রিয়াও বৃদ্ধি করে থাকে। তোকমার পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ হজমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, তোকমার দানা দেহের জন্য উপকারী কোলেস্টেরল উৎপাদন করে থাকে। এছাড়াও রক্তে চর্বির পরিমাণ কমানো, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে হার্ট সুস্থ রাখে। হাড় গঠনে সাহায্য করে।
তোকমার দানা হচ্ছে উদ্ভিজ্জ ওমেগা অ্যাসিডের সবচেয়ে ভালো উৎস। আর এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান প্রদাহ, ক্যানসারের কোষ প্রতিরোধ এবং বার্ধক্য রোধে সহায়তা করে থাকে। তোকমা দানায় হাইড্রোফোলিক উপাদান থাকায় খুব সহজে পানি শোষণ করে।
গরম কালে তোকমার শরবত ভেতর থেকে শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে। তোকমা রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকে। নিয়মিত তোকমার শরবত সেবন করলে ঠাণ্ডা ও মৌসুমি জ্বরের সমস্যা হয় না। তোকমা লিভারকে ভালো রাখে। তোকমার শরবত হতে যে উপকারগুলো পাওয়া যাবে–
দেহের তাপ কমায়
গরমকালে দেহের তাপমাত্রা কমাতে সহায়তা করে তোকমা। আর এ কারণে গরম আবহাওয়ার দেশগুলোতে বহু মানুষ তোকমার শরবত পান করে। এটি সুস্বাদু করার জন্য চিনি, মধু এবং কোথাও কোথাও নারিকেল দুধ দেওয়া হয়।
রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ
রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর তোকমা। মূলত দেহের বিপাকক্রিয়া ধীর করে দেয় তোকমা। ফলে কার্বোহাইড্রেটকে গ্লুুকোজে রূপান্তরের পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। এ কারণে টাইপ টু ডায়াবেটিস যাঁদের রয়েছে, তারা এটি নিয়মিত খেতে পারেন।
কোষ্টকাঠিন্য দূর করে
কোষ্টকাঠিন্য সমস্যা দূর করতে খুবই কার্যকর তোকমা। সামান্য তোকমা অল্প পানিতে ভিজিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পর তা দুধে মিশিয়ে খেলেও উপকার পাওয়া যাবে। এটি হজমের সমস্যাও দূর করতে সহায়তা করে।
এসিডিটি দূর করে
তোকমা এসিডিটি দূর করতেও কার্যকর। এটি পেটের এসিড নিয়ন্ত্রণ করে জ্বালাপোড়া দূর করে। এ জন্য পানিতে সামান্য তোকমা বীজ ভিজিয়ে রেখে পান করতে হবে। তোকমার বীজ পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, যা দেহের ক্ষতিকর পদার্থও দূর করতে সহায়ক।
সুস্থ ত্বক ও চুল
ত্বকের নানা সমস্যায় তোকমা ব্যবহার করা যায়। এ জন্য কিছু তোকমা বীজ গুঁড়ো করে তা নারিকেল তেলের সঙ্গে মাখিয়ে ত্বকে লাগাতে হয়। এটি নানা চর্মরোগ নিরাময়ে কাজ করে। এটি একজিমা ও সোরিয়াসিস নিরাময়ে কার্যকর। সুস্থ চুলের জন্য এটি নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে।
ঠাণ্ডার সমস্যায়
তোকমা বীজে রয়েছে ঠাণ্ডা প্রতিরোধী উপাদান। এটি আপনার দেহকে ঠাণ্ডার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়তে সহায়তা করবে। সর্দি-কাশি থেকে দূরে থাকতে চাইলে তাই নিয়মিত তোকমা খাওয়া যেতে পারে।
ওজন কমাতে
দেহের ওজন কমাতে এ বীজের জুড়ি নেই। পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখলেই বীজটি ফুলে ওঠে। এরপর সেই পানি কিংবা নানা মসলা দিয়ে তা সুস্বাদু করে পান করা যায়। তোকমার ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ছাড়া এর নানা উপাদান দেহের চর্বি কমাতে সহায়তা করে। এতে রয়েছে প্রচুর আঁশ, যা বাড়তি ক্ষুধা দূর করে এবং পেট দীর্ঘক্ষণ পরিপূর্ণ থাকার অনুভূতি দেয়।
যেভাবে পান করবেন তোকমার বীজ
১ টেবিল চামচ পরিমাণ তোকমার বীজ এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। ছোট ছোট কালো দানার বীজগুলো সারারাত ভিজে ফুলে উঠবে। সকালে এই পানি ফুলে ওঠা তোকমা বীজসহ পান করে নিন খালি পেটে। সাথে ১ চা চামচ খাঁটি মধু যোগ করতে পারেন।
তোকমার বীজের শরবত সারাদিন আপনার মেটাবোলিজম বা বিপাক ক্রিয়ার হার বেশি রাখবে, ফলে খাবার ভালোভাবে হজম হবে ও বাড়তি ক্যালোরি জমে থাকবে না। এছাড়াও অতিরিক্ত ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে বেশি খেয়ে ফেলার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করবে তোকমা। নিয়মিত তোকমার শরবত পান করার পাশাপাশি অতিরিক্ত মিষ্টি ও ভাজাভুজি খাবার অভ্যাস ত্যাগ করলে বিনা পরিশ্রমেই দেহ হবে ছিপছিপে। বিশেষ করে মেদ ভুঁড়ির সমস্যা একেবারেই চলে যাবে।